বাক্‌ ১১৩ : সম্রাট সেনগুপ্ত




মেল সিঙ্গার 

‘স্যার আমি একজন মেল সিঙ্গার’ – কথাটা ধীরাজের বুকে উদ্যত ছুরির মতো নেমে এলো ধীরে ধীরে। ধীরে ধীরে কারণ তখন মায়াময়ী নর্তকীরা আলো আঁধারে প্রেতপৃষ্ঠ। রঙিন আলোর নিচে এই অপারেশন টেবিল ছেড়ে উঠে যাওয়া এত সহজ না। আজন্মলালিত যৌন অভ্যাসে চোখ হৃদয় এবং শ্রবণ যন্ত্রের চেয়ে তীক্ষ্ণ। চোখ কেবলি চলে যায় খোলা চামড়ায়, পৃষ্ঠদেশে, বক্ষের বিভাজিকায়, নাভীদেশে। তবু কথাগুলো ছুরির মতোই প্রবেশ করেছিল শরীরে – তৈরি করেছিল গভীর ক্ষত, যেমন একে একে জ্বলে ওঠা নিয়ন পোস্টার বিদ্ধ করে শহরের প্রেতযোনী। গর্ভবতী করে। নির্মিত হয় বিলাসবহুল হোটেল, ফ্লোটেল, ডিস্কো, রেস্তোঁরা, কাফে, মাল্টিপ্লেক্স, থিম পার্ক, বহুতল, আবাসন। নগ্ন কলকাতার বিলাসী পিপাসী ক্লান্ত, রিক্ত বুকে কৌতুহলের মতো নেমে আসে সেই বরফ-হিম প্রশ্ন – ‘স্যার আমাকে একটা গান গাইবার জন্য একটু রিকোয়েস্ট করবেন?’ হরষ বিষাদের এই স্নান যাত্রায় সুশীল সুঠাম যুবকের এই প্রশ্ন মেলায় ঘুরতে আসা একাকী বালকের এক পয়সার বাঁশি না কিনতে পারার বিশ্বগ্রাসী কান্না হয়ে ফাটিয়ে দেয় ডলবি ডিজিটাল। এক মুহুর্তের ভগ্নাংশের জন্য হলেও সমস্ত ডেসিবেল ছাপিয়ে ধীরাজের পাকস্থলীতে তৈরী হয় শূন্য গহ্বর। মদের গ্লাসটা শেষ করে নেয় এক চুমুকে। সঙ্গী দুজনকে বলে ‘চল, বিলটা মিটিয়ে দিয়ে বেরোই’। ওরা একটু অবাক হয়, কিন্তু মেনে নেয়। লেকিন রাত তো আভি জাওয়ান হুই হে। লাস্য হাস্যময়ী নারীদেহের প্রগলভতা খুলছে, ভাঙছে আর জুড়ছে একটু একটু করে। ঠিক যেন গন্ডগ্রামে আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পরা গ্লোবাল ভিলেজ। আহা! দুই গবেষক বন্ধু উঠে পরে টেবিল ছেড়ে। তাদের গ্লাস আগেই শেষ হয়েছে। বিল মেটায়। ক্যাশ ভালোই খসে। অভিজ্ঞতার দাম। অ্যানথ্রোপলজিতে অভিজ্ঞতার দাম অনেক। ক্ষণিকের জন্য হলেও যৌন অবজেক্টকে গবেষণার বিশয় করে তোলাটাও কম অভিজ্ঞতা নয়। তারা এথনোগ্রাফি লিখবে – জাতি আলেখ্য – মানুষের বেঁচে থাকার সমাজতত্ত্ব। ধীরাজ স্থির করে সেও লিখবে। তবে গল্প। আজ্ঞে হ্যাঁ আসন্ন গল্পের যে আশঙ্কা পাঠক করছেন তা সত্য বটে। অতঃপর যা ঘটবে তা গল্পের ধীরাজের সাথে বর্তমান লেখকের পাঞ্জা কষা। কে জিতবে বলা শক্ত। তবে বাস্তবের সাথে কল্পনার পাঞ্জায় বাস্তব যেমন কল্পনার দিকে হেলতে পারে, তেমনি কল্পনা বাস্তবের। অপেক্ষা করুন।
এক ইয়েহি বাত না ভুলি...জুউউউলি...আআ...আআ...আ...আই লাভ ইউ” – প্রথমবার ডুয়েট গেয়েছিল দুজনে – প্রশান্ত ও সুভদ্রা, সেই থেকে সুভদ্রার পেন নেম এ লাইনে জুলি। মধুমাখা দিনান্তের চন্দ্রালোক যখন বারের গ্লাসে বিচ্ছুরিত ডিস্কো আলোয় ম্লান হয়ে আসে কুহকিনী জুলি গেয়ে ওঠে – “জুউউউলি...জুউউলি লাভস ইউ...”। নামে র-ফলা থাকায়, উচ্চারণের সুবিধার্থে প্রশান্তও একদিন সুশীল হয়ে যায়, গায়ক সুশীল কুমার – সোনালি কেবিনের একমাত্র মেল সিঙ্গার। হোটেল মালিক অবশ্য রেস্তোঁরায় গান নাচ ইনট্রোডিউস করার পর বারের নাম আলাদা করে দেন সোনালিজ। একটু ইংরেজি ফ্লেভার না থাকলে সন্ধ্যার রাম ঠিক বাতাসে ওড়ে না। যেমন জুলি...জুলি লাভস ইউ। ওপরের হোটেলের নাম অবশ্য একই থাকে। জনৈক আঁতেল ধরনের ব্যক্তি কোন এক রাতে নেশায় মত্ত হয়ে মালিককে বলেছিল “এয়ে নাম তো আপনে বড়িয়া রাকখা...”। তারপর থেকে সে বড়াই করে বলে “আই লাভ বেঙ্গলি পোয়েট্রি...ইস লিয়ে নাম বেঙ্গলি পোয়েম পার দিয়া...”। হবে নাই বা কেন – বেশিরভাগই ইদানিং বাঙালি কাস্টমার – মাঝে সাঝে দু একটা কবি, অধ্যাপকও ঢুকে পরে। নাম পরিবর্তনের পরেও সুশীল তাই বলতে ভালোবাসে সে সোনালি কেবিনের পুরুষ গায়ক। ২০১২ সালের প্রথম দিকে যেবার ধীরাজরা এখানে প্রথম এসেছিল তখনও এখানে গান গাইত সুশীল। সম্ভবত তারা সুশীল-জুলির ডুয়েটও শুনেছিল। স্মৃতি বিশ্বাসঘাতক, স্মৃতি সন্ধ্যার বক্ষ-পৃষ্ঠ উন্মুক্ত নায়িকার নেশায় মাতাল, স্মৃতি বিভাজিকার মতোই বিভক্ত – উন্মুক্ত অথচ পর্দানাশিন। হায়, তারা কেউ সেদিনের হাল্কা দাড়ির, সরু গোঁফের সদ্য কলেজফেরত প্রশান্ত অরফে সুশীলকে মনে রাখে নি। স্বচ্ছ ভারতের প্রকাণ্ড ঝাঁটায় বিষন্ন গার্বেজ ডাম্প শহর থেকে শহরতলিতে সরে যায়...কলকাতার ওজন বাড়ে, উচ্চে ওঠে রমণীয় ঘরবাড়ি। হাস্য লাস্যময়ী সন্ধ্যায় রাস্তার ধারের কভার্ড নোংরার লজঝর ময়লা ফেলার কৌটোর আঘ্রাণ মিললেও দেখা মেলে না। মাঝে মাঝে তাই সুশীলকে গলা কাঁপিয়ে গাইতে হয় “তোমার দেখা নাই রে, তোমার দেখা নাই...”। পাড়ার ক্লাবে আজকাল ওসব কিসোর কন্টি ফন্টি চলে না। এখন ফোক ব্যান্ডের যুগ। “শালা লোকাল ট্রেনের ভিখিরির মতো রপি কিসোর মারালে, খুচরো পয়সাই যুটবে...যুগের সাতে চলতে হবে বুঝলি” – পাড়ার ক্লাবের জেনারেল সেক্রেটারি শ্যামলদা বলেছিল। প্রশান্ত এইসব অবমাননার পাশে, টিফিনের সামান্য পয়সা জমিয়ে কেনা “বেস্ট অফ কিশোর”, “বেস্ট অফ রফি” তে হাত বোলাতো। বন্ধ ঘরে অচল ক্যাসেটগুলোর মতো কেঁদে উঠতো তার গলা – “তুমি আমি একই আছি দুজনে যা ছিলাম আগে...”। বাইরে বাবার গজগজ – “বুড়ো বাপের ঘারে বসে আর কদিন রফি, কিশোর, আশা, লতা, জিন্স, টীশার্ট, কালিপূজোর ফাংশান এসব হবে...থার্ড-ইয়ারটা কমপ্লিটও করলি না, এই গানই তোর সর্বনাশ!”

২০১২ সালে যখন সোনালি কেবিনে প্রথম গান গাইতে এলো প্রশান্ত তখনো নিজের আসল নামটাই ব্যবহার করত। যে ছেলেটা বাসন মাজত তার নামও প্রশান্ত ছিল। জুলিই প্ল্যানটা দেয় “প্রশানদা তুমিও আমার মতো নামটা পালটে নাও না”। মন্দ লাগেনি প্রস্তাবটা। গায়ক সুশীল কুমার। এক সময় ই এম বাইপাসের ধারে একটা বারে গান গাইতেন তিনি। তারপর এইচএমভি সারেগামা। সেখান থেকে প্রথম বাংলা ছবিতে প্লেব্যাক সিঙ্গার। ছবির নাম “স্বপ্ন শেষ – দ্য ড্রিম এনডস”। আহা! চটকা ভাঙে সুশীলের। স্বপ্নলব্ধ নাম ধরে কেউ ডাকে “ওয়ে সুসিল এক পেগ বানা না রে বাপ...”। কেষ্টদা। প্রমোটারি, বাড়ি তৈরির কাঁচা মাল, পাড়ার অনুষ্ঠানে খাওয়াদাওয়ার আয়োজন, ডেকোরেশনের ব্যবসা – এরকম হাজারো কোম্পানির মালিক কেষ্টদা। শোনা যায় এই হোটেল-বার-রেস্তোঁরাতেও তার একটা শেয়ার আছে। কেষ্টদার কল্যানেই চাকরিটা পায় প্রশান্ত। দাদা রফি আর কিশোরের ফ্যান।
“কই গা দেকিনি একটা!”
“জিও গুরু ফাটিয়ে দিয়েছো”।
“নে এক পেগ খা, লজ্জা পাস না বে, আমি তোর দাদার মতো”।

“চাকরিটা আমি পেয়ে গেছি বেলা সত্যি”...আজ কিশোর ছেড়ে অঞ্জন দত্ত। বেলা বোস তুমি কোথায়? সুভদ্রাই কি তার বেলা বোস? সুভদ্রাই তো তাকে নিয়ে এসেছে কেষ্টদার কাছে। সে নাকি কেষ্ট পালের খুব ‘ক্লোজ’। এই ‘ক্লোজ’ শব্দটার মানে এখনো বের করে উঠতে পারে নি সাধাসিধে প্রকৃতির প্রশান্ত। ছ বছর বয়সে শুনেছিল কিসসু করার নেই, তাদের গ্রাম ছাড়তেই হবে কারন প্রজেক্টটা যে কোম্পানির তারা মুখ্যমন্ত্রির খুব ক্লোজ। ২০০০ সালের গোড়ার দিকে তার বাবা ভলেন্টারি রিটায়ারমেন্ট নেয়। পেনসন আটকে যায়। ক্ষমতাসীন দলের ক্লোজ কিছু লোকের সাথে বচসা বাঁধে বাবার। সাড়ে তিন বছর লড়াই করার পরে আদালত নির্দেশ দেয় বকেয়া সহ পেনসন ফিরিয়ে দেওয়ার। পেনসন আসতে থাকে, বকেয়া আসে না। শহরতলীর এক ঘিঞ্জি বস্তির কয়েক হাত ঘরের নরক থেকে তারা অতঃপর কাছাকাছি এক দমবন্ধ করা সাড়ে চারশ স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাটে উঠে আসে। ফ্ল্যাটটা মোটামুটি কমেই মেলে কারন বিরোধী দলের এক ক্ষমতাশালী নেতার খুব ক্লোজ ছিল সুশীলের মাসতুতো বোন রিমলির বেস্ট ফ্রেন্ড। সে সেই নেতার ছেলেকে প্রাইভেটে পড়াতো। এসব সত্য অবশ্য কোন ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরায় ধরা পড়ে না। পলে সুশীল বুঝতো কি করে তিন বছর ধরে কেষ্টদার পেগ বানিয়ে, জুলির সাথে ডুয়েট গেয়েও তার মাইনে দু হাজারের বেশি হয় নি আর পিতৃহীন জুলি অথবা সুভদ্রা নতুন ফ্ল্যাটের লাখ দশেক টাকা ডাউন পেমেন্ট করেছে এ বছর।
মাঝে মাঝে ফেরার সময় রাত হয়ে গেলে হপ্তায় এক দু দিন সে আর জুলি এক সাথে ফেরে। মাঝের একটা ছোট চাইনিজ রেস্তোঁরায় খেয়ে নেয় দুজনে। “শালা রোজ বাইরে খাস, ঘরে তো এক পয়সাও দিতে পারো না, এতো টাকা কে দেয় তোমায়”। জুলিই দেয়। সে কথা আর বলে না বাবাকে। সত্যিই তো জুলিই বা কোথা থেকে পায়? রাত যত বারে, জুলির, জুলিদের, ওদের ৪-৫ জনের টিপসের ভাঁড়ার ফুলতে থাকে। লজ্জায় লাল হয়ে গান শেষ করে রোজ টেবিলে টেবিলে ঘরে বেড়ায় সুশীল। গেলাসের বিচ্ছুরিত আলোয় সে প্রেতসর্বস্ব। প্রথম চাকরি পেয়ে একটা ভালো চশমা কেনে সুশীল। পরের মাসে জিন্স। তার গল্পটা সিনেমার নিম্নমধ্যবিত্ত নায়কের মতো কিছুতেই হয় না। প্রথম মাইনে পেয়ে বাবার জন্য পাঞ্জাবি, মায়ের জন্য শাড়ি। দুজনের চোখে জল। আহা! আহা! সুশীল স্বার্থপর। তাই তো অনেক কষ্টে জমানো হাজার দশেক টাকায় ঘরের বন্ধ রেফ্রিজারেটরটা না বদলে সোনির সিডি প্লেয়ার কিনে আনল। জুলি গত মাসে এসি বসিয়েছে নতুন ফ্ল্যাটে। “গুরু তোমার সুভদ্রা জুলি হয়ে গেছে...কার কার বাইকে বসছে তুমি জান...ওকে ছাড়!...” একটা গালি দিতে যায় জয়ন্ত। তার আগেই হাতটা খামচে ধরে সুশীল। করুন আর্তি দুই চোখে “প্লিজ”। এক চুমুকে অর্ধেক পেগটা শেষ করে। মদে ভিজে যায় বুক – জামা। ছোটবেলার বন্ধু জয়ন্ত কোন মতে খামচে ধরা হাতটা ছাড়ায়। সসালা তার অনীতা যদি এরকম করত তবে জ্বালিয়ে দিত না সব কিছু! গত মাসে অনীতার বিয়ে ছিল...তবু অনীতা তো অন্তত সুভদ্রার মতো...। একটা কালসাপ অন্ধকার সন্ধ্যার মায়াবি আলোকে বিদ্রুপ করে পাকিয়ে ওঠে। রাস্তার তিন বাতি নিভে যায় সে রাত্রে। বাইকের শব্দ। জুলি ডুবে যায় অদ্ভুত আঁধারে। আজ কেবল ফল্ট সারা রাত।
ধীরাজরা প্রথমবার তিন বন্ধুতে এসেছিল। তার কাছের বন্ধু ইতিহাসের গবেষক প্রবীর। আর উলটো দিকের চেয়ারে অগ্রজপ্রতিম আমেরিকা নিবাসী সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্বের গবেষক সাগরদা। সাগরদা কাজ করছে ক্রমশঃ পরিবর্তনশীল কলকাতার নগর-স্থান নিয়ে। শপিং মল, বার, পাব, নাচগানউচ্ছল পানশালা, হাউজিং কমপ্লেক্স এই সব শহরকে এক উন্মাদ হিংস্রতায় কোন উন্নয়ণের দিকে নিয়ে যাচ্ছে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে সে। তিন বন্ধুর যুখবদ্ধ মাতলামোর ইচ্ছার সাথে গবেষকের অনুসন্ধিৎসা মিলে মিশে তৈরি হয়েছিল সন্ধ্যার ককটেল। সেখানে ইন্দ্রের ঐষর্যের মাঝে ইন্দ্রপতনের কোন সম্ভবনা দেখে নি তারা। আবেশে উন্মত্ত পুরুষের পকেট থেকে ঝড়ে পরছে পাঁচশ টাকার নোট – ন্যুনতম একশ। মধ্যবিত্ত অধ্যাপক, গবেষকদের পকেট থেকেও এই অছিলায় ভালোই খসে। তবু অনেক অপেক্ষা করেও তারা সঠিক ভাবে বুঝতে পারে না নোটগুলো ঠিক কোন উদ্দেশ্যে উড়ছে। কোন শক্তিমান, অর্থবান পুরুষের কাছে কিভাবে পৌঁছবে বিনিময়মূল্য। সুসজ্জিত বিপনন কেন্দ্রে বেচাকেনা, মৃত্যু অথবা যৌনতা কোনটাই ঠিক মতো বোঝা যায় না। সুবেশি তরুণী কাছের মানুষের মতো বলে “মে আই হেল্প ইউ স্যার”। হাঁকডাক দরদাম নেই এই বাজারে। ক্রেতা, বিক্রেতা, মালবাহক, প্রদর্শক, পরিদর্শক সকলেই হাসিখুশি। সেদিনের সরু গোঁফ আর হালকা দাড়ির স্মিতহাস্য সুশীলকে আজ দেখলে যেমন যে কেউ ইংরেজির অধ্যাপক মনে করতে পারে। ক্লিন শেভ, চোখে চশমা। জুলিকেও মনে করা যেতে পারে নায়িকা – এক্সমডেল যার শরীর থেকে ছিটকায় আলো – বাসন মেজে হাজা ওঠা কিশোরীর হাতে বিলিতি নাইট ক্রিম। আর তুলনায় গুন্ডা প্রকৃতির যে লোকগুলো একের পর এক পাত্তি ছড়াচ্ছে তাদের পোশাক ও ভঙ্গি দেখলে মনে হবে শ্রেণিসংগ্রাম বুঝি বা অবশেষে সফল হয়েছে, দেশে আর টাকার অভাব নেই কারো। সর্বহারার কর্তৃত্বে শ্রমিকেরা বুঝি অধ্যাপকের থেকেও ধনী। এই ঘুলিয়ে যাওয়া বাতাবরণে কোন গবেষকের পক্ষেই কি নরনারীর যৌন আগমন প্রত্যাগমন বোঝা সম্ভব? বা বুঝলেও এম্পিরিকাল রিসার্চ? তথ্য সংগ্রহ? শকুন্তলারা যেদিন সুখের বৈভবের রাজপ্রাসাদে আসবে তদ্দিনে অভিজ্ঞানস্বরূপ আংটিটিও হারিয়েছে বিরাট এক মাছের অজ্ঞাত পেটের ভিতর।
দ্বিতীয়বার ২০১৫ সালে যখন ধীরাজ অ্যান্ড কোম্পানি সোনালিজে খেতে গেল সে সময়ে খবর কাগজে নিত্যদিন সিঙ্গিং বারে রেড হওয়ার খবর বেরুচ্ছে। মাঝেসাঝেই ইন্দ্রপতন। কারো কারো শরীর অনাবৃত – কারো কারো হাতে উদ্যত আগ্নেয়াস্ত্র। সেই হাওয়ায় এবার সাগরদাকে ছাড়াই দুই কৌতুহলি পুরুষ গবেষক দেখতে গেছিল রাত্রি আলোকে ছাপিয়ে কতটা বিবস্ত্র হয়েছে। দুটো গান গেয়েই উঠে গিয়েছিল জুলি, সাথে কোনের চেয়ারের লোকটাও। সঙ্গে সঙ্গে স্বল্পবাস পরিহিতারা নানা বিভঙ্গে ডিজে মিউজিকের সাথে নাচ শুরু করে দিল – ‘দারু পিকে ডান্স করে ডান্স করে ডান্স করে’। বলিষ্ঠ চেহাড়ার বাউন্সারেরা টাকা সংগ্রহের জন্য এদিক সেদিক ঘুরছে। মাঝে সাঝে পেগ শেষ হওয়া টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে তাগাদা অথবা উঠে যাওয়ার ইঙ্গিত। এদেরই একজন জুলির সেটিংটা করেছিল। সুশীল লক্ষ্য করে নি কখন সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেছে জুলি। নাচ শুরু হওয়া মাত্র ধীরাজদের টেবিলে একজন। “স্যার আর কিছু লাগলে বলবেন” – ধুর্ত দুই চোখে স্পষ্ট ইঙ্গিত। ছড়িয়ে থাকা লোকেরা বাউন্সারদের থেকে খুচরো করাচ্ছে – ১০০ টাকার ভাঙানি দশ দশ টাকায়। চোখ সরু করে প্রদীপ – “দেখেছিস সারদা কান্ডের পর লোকের হাতে টাকা কত কমে গেছে...সেই সব কাস্টমার কই যারা পাঁচ পাঁচশর নোট ছড়াতো?” “ঐ দেখ পাশের টেবিলে যে বসে আছে সে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ায়” – বলে বাবু? বাবু এই দলে নতুন। এবারে আর সাগর আসতে পারে নি। সে আমেরিকায় গবেষণাপত্র রচনায় ব্যস্ত। সে থাকলে হয়ত নগরায়নের এই পরিবর্তিত রুপ নিয়ে কিছু বলতে পারত। পিছনের বস্তিতে জমা জলে ম্যালেরিয়ার মশা জন্মালে স্কাইরাইজারের মানুষেরা নাবুঝ হয়। ময়লার ভ্যাট ফুলে ওঠে – দূর্গন্ধ লেগে থাকে সুন্দরী শহরের রূপচর্চিত আত্মার ভিতর। “স্যার আমাকে একটা গান গাইবার জন্য একটু রিকোয়েস্ট করবেন?” টেবিলে টেবিলে ঘুরতে ঘুরতে ধীরাজদের কাছে পৌঁছে যায় সুশীল। তাকে এতক্ষন আলাদা করে লক্ষ্য করেনি ধীরাজরা। বাউন্সারদের ভীরে সেও মিশে ছিল। টাকা কালেকশনে সাহায্যও করছিল মাঝে সাঝে। এমাসে কেষ্টদা বলে দিয়েছে আর কিছু করতে পারবে না। “দ্যাখ ঐ মেয়েগুলোকে পুষতে টাকা লাগে, শালা বহুত দেমাগ মাগিগুলোর…আর পাবলিকও তেমন ঢ্যামনা, কিশোর, রফি, মুকেশ না শুনে শুনবে হানি সিং…কুত্তাদের গাঁড়ে লাথ মারতে ইচ্ছে করে…ও মালগুলো কি বুঝবে কিসোরদার গানে কী পেইন…আহা…গা না রে একটা…গা না…”। তবে কি কেষ্টদা কিছু টের পেয়েছে? কেষ্টদার শত কান, তার পক্ষে জানা অসম্ভব নয় হপ্তায় অন্তত দুদিন চাওমিন আর মোমো দিয়ে সে আর জুলি হ্যাংস্যাং-এ ডিনার সারে। বিশেষত জুলি যেহেতু তার ক্লোজ। মাইনে গত মাস থেকেই বন্ধ।
“দেক বেটা হামি আর পারবে না…পোলিস য়োলিসকে রুপিয়া দিতে সসালা পিছন ফাটছে…তু দেক ও যো টিপস উইপস আচে না, ওতে যদি চলে…তু লেড়কা আচ্ছা হায়, তু গান গাইলে আমার কী প্রবলেম আচে…হাঁ”?
এই তার শেষ মাস। গত সাতদিনে একবারও মদ ছোঁয়নি সুশীল। গলা ঠিক রাখতে হবে। প্রমাণ করতে হবে তার গান লোকে শুনতে চায়। সে তো চেষ্টা করেও আর বাউন্সার হতে পারবে না, পারবে না দালালি করতে। ব্রাহ্মনের ছেলে প্রশান্ত চ্যাটার্জি – বাবা প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক হওয়া সত্ত্বেও লেখাপড়ায় বিলো অ্যাভারেজ। ঐ গানের গলাটাই যা আছে। “উফ প্রশানদা, তুমি যা গাও তোমার আর চিন্তা কিসের…তোমার ঐ গলা যদি আমার থাকত!” জুলি বলেছিল পাড়ার ফাংশানে একসাথে রেওয়াজ করার সময়।

“এবার আপনাদের সামনে মহম্মদ রফির একটি বিখ্যাত গান পরিবেষণ করবেন গায়ক সুশীল কুমার”
ধীরাজের অনুরোধে কাজ হয়। একটা গান গাইলে দোষ কি? শালা এই অন্তর্জালের যুগে ওরকম বিভাজিকা আর কোমর কয়েকটা বোতাম টিপলেই দেখা যায়। একটা নয়, দুটো গান গাইবে সে। সম্ভব হলে আরো বেশি। প্রথমে শুরু করবে কিশোর দিয়ে, তারপর রফি। ঠিক করে সুশীল। গলা ঠিক করে নেয়। বলে “যদি অনুমতি দেন দুটো গান শোনাবো, প্রথমে একটা কিশোর, তারপর রফি”। হাততালি থমকে যায়। ধুসস শালা। এখন এক পেগ নষ্ট। দুটো গান শুনতে হবে তাও এই দামরার থেকে। জুলি রাণী গেল কই।
“কই হামদম না রহা...” গান ধরে সুশীল।
জুলি রাণী কোথায়? এই প্রশ্ন বিদ্ধ করছিল কেষ্ট পালকেও। সশব্দে দরজা খুলে যায় সোনালিজ বারের। নিচে ফ্যামেলি রেস্টুরেন্ট, ওপরের তলায় বার আর তে তলা, চার তলায় থাকার ব্যবস্থা। কেষ্ট পাল আর তার দুই অনুচর সুশীলকে গান গাইতে দেখে বেরিয়ে যান। বাইরের গেটকিপারকে সে কিছু একটা জিজ্ঞেস করে। তারপর একটা অশ্রাব্য খিস্তি দিয়ে মুখে হিসহিস শব্দ করতে করতে উঠতে থাকে তিন তলায়। একটা গান শেষ। এরপর রফি। স্তব্ধ বারে ধীরাজ একা হাততালি দিয়ে ওঠে, দেখাদেখি তার সঙ্গী দুজনও। শুরু হয় সুশীলের দ্বিতীয় গান “ইয়ে দুনিয়া, ইয়ে মেহেফিল মেরে কাম কী নেহি”। “দূর বাল!” – ধীরাজের খুব কাছ থেকে শব্দটা ভেসে আসে। উসখুস শুরু হয়ে যায় বারে। জনৈক ব্যক্তি পেগটা শেষ করে উঠে দাঁড়ায়। মৃদু গুঞ্জন মাইকের শব্দে ম্লানভাবে হলেও জেগে থাকে। গান শেষ হয়। নো ক্ল্যাপিং। একজন বাউন্সার তার কানে কানে কিছু বলে। মাথা নারে সুশীল কুমার। এবার থেকে সে আবার প্রশান্ত – শুধুই প্রশান্ত। নেমে আসে স্টেজ থেকে ধীরে ধীরে – শেষবারের মতো। আবার ধীরাজ হাততালি দেয়। ভালো গায় কিন্তু ছেলেটা। বাহ! পাশ থেকে একটা বিরক্তির শব্দ শোনা যায়।

দরজা ঠেলে বাইরে বেরিয়ে যায় প্রশান্ত। তারস্বরে গান শুরু হয় ভিতরে “পিঙ্ক লিপস, পিঙ্ক লিপস”। তিন তলায় জুলির রুমের টিভির ভলিউমটা বেড়ে যায় হঠাৎ। দরজাটা ফাঁক করে যখন প্রশান্ত বেরোয় তখন একটা চাপা বিস্ফোরণের শব্দ শোনে ধীরাজরা। সম্ভবত গুলির। তারা বিল মিটিয়ে নিচে আসে। দেখে একটা পুলিশ ভ্যান আলো জ্বালিয়ে তীব্র শব্দে এসে দাঁড়ায়। সুশীল ওরফে প্রশান্ত তখন দূরের অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে।

সোনালী কেবিনের টুনিবাল্ব ও হ্যালোজেন অধ্যুষিত শরীরে পুলিশ প্রবেশ করে। ধীরাজের কানে অন্তরের সমস্ত পরাবাস্তব লিখনি ছাপিয়ে ধ্বনিত হয় যেন আরেক গুলির শব্দ – “
স্যার আমি একজন মেল সিঙ্গার”। জুলির রুম থেকে তখন তারস্বরে এক নৈর্ব্যক্তিক কন্ঠস্বর গেয়ে চলেছে – “চুপ চুপ কে চুপ চুপ কে চোরি সে চোরি, চুপ চুপ কে চুপ চুপ কে রে…।“
রোজ রোজ এমনই জোড়া পেগের ধাক্কায় মেলোড্রামারা মরে। সুতরাং সিঙ্গিং বার থেকে বেরিয়ে গল্পটা ধীরাজের মাথা থেকে কপ্পুরের মতো উবে যায়। ইস ছেলেটার হয়ে বললে হতো! কী আর এমন ক্ষতি ছিল একটা গান গাইলে। জনৈক ভিখিরি শিশু হাত বাড়ায় ক্ষুধার্ত ল্যাম্পপোস্ট থেকে এক চিলতে আলো হয়ে। ক্লান্ত মাতালের গল্পের মতো কয়েনের বদলে উড়ে আসে নোট। নিরুত্তর গুলিটা গল্পের মাঝখানে এসে কাঁপতে থাকে। অবশেষে গল্পটা টাঙানো হয় একটি অসমাপ্ত অনুরোধের পেরেকে - নাম না জানা এক যুবকের ভাষ্য – স্যার আমাকে একটা গান গাইবার জন্য একটু রিকোয়েস্ট করবেন?”

                                                                                    (চিত্রঋণ : John Muafangejo)

2 comments:

  1. ভাল। আজকের বাস্তবতার যে নির্মমতা দেখাতে চেয়েছ , সেটা হয়েছে সুচিভেদ‍্য। আরো লেখ।

    ReplyDelete