বাক্‌ ১১৩ : জ্যোতির্ময় বিশ্বাস




বিন্দু বিন্দু ঝরে জল

খুব ইচ্ছে করছে একটা নাম দিই এই ঘরটার এর আগে অনার্সের সময় আমি যে ঘরটায় ছিলাম, তার বাইরে দরোজার ওপরে চক দিয়ে লেখা ছিলোরুম নম্বর ২ কিন্তু তাকে নাম বলা চলেনা, নির্দেশমাত্র যদিও নামের আসল কাজটা তাই, তবু রাম শ্যাম যদু মধু (উদাহরণ অত ঘটা করে কী দেব) ব্যাপারটা তো আছেই নইলে আমিও তো অমুকবাবুর২নং পুত্রহয়ে থাকতাম আজ যাইহোক, এখন আমি অন্য মেসে, আর আগে এরূপ চিন্তাভাবনা মাথাতেও আসেনি এই মেসটাতে আবাররুম নম্বর অ্যাতো এরকম কোনো সিস্টেম নেই অল্পকিছুই ঘর, বিশেষ চিহ্নিতকরণ প্রয়োজন হয়নি এই ঘর অমুকের ওটায় তমুক আর কোণার ঘরটায় জ্যোতির্ময়, এভাবে জানাজানি আছে

সেদিন কী কী ভাবতে ভাবতে সেই কোণার ঘরটারই একটা নাম দিতে চাইলাম স্কুল কলেজে যেমনসুকান্ত কক্ষ’, ‘আশুতোষ কক্ষথাকে তেমন নয় বেশ রোমান্টিক একটা নাম হওয়া চাই, নিজের কাছে এই দাবিও রাখলাম জানি পাগলা ইচ্ছে, কিন্তু ইচ্ছে তো অত ফ্যালনা কিছু নয়

এই যে আমার ঘরটা, সম্ভবত ১২/১৪ ফিটের হিসাব, ওপরে টিনের চাল, পাতলা প্লাইউডের সিলিং তিনটে পেশাদার জানলা ঘরের দুদিকের দেয়ালে আমার চৌকিটার ঠিক ওপরে নয়, একটু সরে, সিলিং থেকে বাদামি রঙের একটা ফ্যান ঝোলে দুটো টেবিল, একটাতে থালাগ্লাসবাটিচামচ, একটা ইলেকট্রিক কেটল আর কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস রাখা টুথপেস্ট সাবান ইত্যাদি আরেকটা টেবিলে শুধু বই আর খাতাপত্র আমি ভেবে দেখলাম এদেরও কারোর কোনো নাম নেই না, কাপ-কে কাপ বা ফ্যান-কে ফ্যান বলা মানে তো মানুষকেমানুষবলার মতো আসলে এদের নাম রাখবারপ্রয়োজনহয়না, কিন্তুইচ্ছেতো হতেই পারে
চিনামাটির কাপটা যেটায় কফি আর স্যুপ বানিয়ে খাই সেটাকে সুপাত্র বলে ডাকতে লাগলাম ফ্যানটাকে চড়াইডানা, রডলাইটটা লাঠিলণ্ঠন, বিছানাটাকে তিস্তাপার বইয়ের টেবিলটাকে অরণ্য আর আমার খাটের ঠিক পাশের জানলাটাকে সীমান্ত বলে ডাকি

কিন্তু ঘরটার কোনো নাম ঠিক করতে পারলাম না, এদিকে জুনমাস এসে পরলো সেমেস্টার কাঁধে নিয়ে আমিও ব্যস্ত হয়ে যাই


তিস্তাপারে শুয়ে আছি এখন পড়ন্ত বিকেল বোধয় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, কিসের আওয়াজে ঘুমটা ভাঙলো উঠে বসলাম উঃ, তুমুল হাওয়া শুরু হয়েছে তো বাইরে! জারুল গাছটা খুবই হেলছে-দুলছে সীমান্ত খোলা ছিলো, দেখলাম হাওয়ার তোড়ে একটা বেগুনি জারুলপাঁপড়ি তিস্তাপারে উড়ে এসে পরলো ওদিকে আলো তোলপাড় করে বাইরে ছায়া ঘনাইছে, বৃষ্টি আসবে


মেসে আমি এখন একা যে দুজন জুনিয়র ছিলো, ওরা থার্ডইয়ার পরীক্ষা দিয়ে এই কদিন আগেই চলে গেলো ওরা চলে যাবার দিনও বৃষ্টি ছিলো তবে এতটা নয়, মৃদু যখন গাড়িতে মালপত্রগুলো তোলা হচ্ছে , আমার মনে পড়ে যাচ্ছিলো ২০১৩ জুনের মাঝামাঝি একটা তারিখ, কলেজে ভর্তির ফর্ম তোলার জন্য ধুপগুড়ি থেকে আমরা তিন বন্ধু- আমি, দিপাস, আর মন্টি জলপাইগুড়ি আসছিলাম জলঢাকার কাছাকাছি তুমুল বৃষ্টি নামলো, সাথে ঝোড়ো হাওয়া সোয়া ঘন্টার জার্নির পর ভেজা ভেজা হয়ে আমরা কলেজে পৌঁছলাম, স্বপ্নের আনন্দচন্দ্র কলেজ বাবা যে কলেজে পড়তো সেই কলেজে পড়বো ভাবতে খুব ভালো লাগছিলো

সেদিন আসাযাওয়ার পথে বাসে আমি ঘুরিয়েফিরিয়ে দুটো গান শুনেছিলাম কবীর সুমনেরএসো করো স্নান নবধারা জলে বলবে কে আর/ শহরে বৃষ্টিজল কাঁদামাখা নোংরা দেদার…”, আর জর্জ বিশ্বাসের কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথ, “এসেছিলে তবু আসোনাই…” সেই থেকে এই গানদুটো আমার জন্যবর্ষার গান বাকিবছর চুপ থেকে জুন-জুলাই নাগাদ যখন বৃষ্টিপাতের কাল, এই গানদুটো হাওয়ায় হাওয়ায় ভেসে আমার কাছে আসে  আমি ফোনে বাজিয়ে শুনি, অবশ্য এটাও ঠিক যে, না বাজালেও শোনা একরকম হয়     

এই গানদুটো একটা পবিত্র দুঃখবোধের কাছে আমাকে নিয়ে যায়না, যে দুঃখ বাংলা প্রেমের কবিতায় চাকরি করে সে নয় অন্য একে ধরে-ছুঁয়ে লেখা যায়না, এ দুঃখের কাছে শুধু নীরবে পৌঁছতে হয়, সম্ভ্রমে আসলে কিছু কিছু গানের উপস্থিতির কাছে আমাদের উপস্থিতি যে নগণ্য, এটা সুমন আর জর্জ বিশ্বাস আমায় বুঝিয়ে দিয়েছেন

এরকমই আরেকটা ব্যাপার আছে আমার আমার শীতকালের একটা অঙ্গ হলো তপন সিনহারগল্প হলেও সত্যিআর ঋতুপর্ণ ঘোষেরনৌকাডুবি কার্ত্তিক আমার সবচে প্রিয় বাংলামাস, সেইসময়টায় আমি এই ছবিদুটো দেখবোই দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে যদিও উপন্যাসটি আমার অধিক ভালোলেগেছিলো কিন্তু দেখি শীতের শুরুয়াদ করিগল্প হলেও সত্যিদিয়ে সেই শেষ দৃশ্যটা...দেখলে মৃদু শীত করে ওঠে অন্তরেবাহিরে অতিরেক নয়, মৃদু, যে মৃদু একপ্রকার আমন্ত্রণ, সে আমাকে কি এক উৎসাহ দিয়ে যায় সাদাটে কুয়াশায় আবৃত পুরাতন কলকাতার চিনচিনে ব্যথাময় ফাঁকা একটা অঞ্চল, ধনঞ্জয় (রবি ঘোষ) সে অঞ্চল হেঁটে পর ক'রে চলে যাচ্ছে


তিস্তাপার ভিজে যাচ্ছে, বৃষ্টির ছাঁট আসছে হুহু করে! আমি কপাট চাপালাম সীমান্তের ও ভালো কথা, এরই মধ্যে ঘরটার একটা নাম পেয়ে গেছি

বাইরে বেরোলাম ছাতা মাথায় মাথার মধ্যে নামটা কীকরে পেলাম  পেয়েছিলাম ওকে! রাস্তায় গোড়ালিডোবা জল জমেছে, ভেঙে এগুচ্ছি আর ভাবছি, এই নাম রাখা কি সুন্দর হবে? আবার ভাবছি, হবেনা কেন, হবে যথেষ্ট সুন্দর সে তাকে তো রেখে দিতে হবে


ঝিমিয়ে এসেছে বারিধারা দোকান থেকে একটা আমূল তাজা দুধের প্যাকেট, ব্রু'কফি আর চারটে অ্যালপেনলিবে কিনে ফিরছি দাঁত দিয়ে অ্যালপেনলিবের মোড়কটা ছিঁড়ে চকোলেটটা মুখে পুরলাম মোড়কটা ছুড়ে ফেললাম রাস্তার জলে দেখলাম খুব দ্রুত মূলস্ত্রোতে ভেসে সে একদিকে চলে গেলো জোরে একটা কামড় দিলাম, এই ছোট ছোট দানা চকোলেটগুলো চুষে খাবার ধৈর্য থাকেনা আমার মুখের ভিতর গরম লালায় চকোলেটের ভাঙা অংশগুলো গলে গলে গলা দিয়ে নামছে


মেসে ফিরে দুধটা সুপাত্রে ঢেলে রাখলাম জ্বালিয়ে দিলাম লাঠিলণ্ঠন, দেখা গেল চড়াইডানা অসুস্থ, চলছেনা মানুষের মতো ওদেরও কি এসময় সর্দিজ্বর হয়! কিজানি একটা কয়েল জ্বেলে অরণ্যের সামনে বসলাম সীমান্ত খুলে দিতে চমৎকার বাতাস এসে আমার নয়, ঘরের বাকি সদস্যদের কুশল নিতে লাগলো যেন কতো প্রেম নিশ্চয় আমার ওপর ওদের প্রত্যেকের কিছু কিছু রাগ আছে ওদের রাগ কিংবা ভালোবাসা কোনোটা বোঝার ক্ষমতাই আমি রাখিনা

ভাবছি এই মেসটা ছেড়ে চলে যাবার আগে দরোজার ওপর কোথাও ঘরের নামটা লিখে যাবো আর মেসের কাকিমনিকে বলে যাবো পরক্ষনেই ভাবলাম, নাঃ, যদি এটা জানার পর পরের আবাসিক ছাত্রটির পছন্দ না হয়! সে তো বদলে অন্য নাম রাখতেও পারে তা ঠিক হবেনা তার চে নামটা আমি একা জানি তাই ভালো এ লেখাতেও বলছি না ছাড়ুন এমন কিছু ফোন নম্বর থাকে তো, যেগুলো সেভ না করলেও মনে থেকে যায়! সেরকম


দরোজা খোলা বাইরে ভেজা ছাতাটা রাখা গা থেকে গড়িয়ে নামছে জল বিন্দু বিন্দু ছাতার রংটা কালো কিন্তু কালো নয়, গোলাপিযেন তিস্তার পারে, অরণ্য থেকে মার্জিত দূরত্বে বৃষ্টিঝরা সন্ধ্যাবেলায় গোলাপি ছাতা মাথায় একজন 'তুমি' দাঁড়িয়ে রয়েছে যেন  দূর থেকে একজন 'আমি' তাকে দেখছে, যেন দূর থেকে তাকে আর কেউ দেখছেনা

                                                (চিত্রঋণ : "The Dawn", woodcut by Li Qun)

4 comments:

  1. আত্মমগ্ন। শুভেচ্ছা।

    ReplyDelete
  2. ভালো লাগল রে। এসব পড়ে তোকে আরো চিনতে সুবিধে হচ্ছে।

    ReplyDelete
  3. ভালো লাগলো। আত্মস্থ লেখা। লিখে যাও।

    ReplyDelete